রমজান মাসে শয়তান বন্দী থাকার পরেও মানুষ কেন খারাপ কাজ করে?
“আবূ হুরায়রাহ্(রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(ﷺ) বলেছেনঃ তোমাদের জন্য রমাযানের বারাকাতময় মাস এসেছে। এ মাসে সওম রাখা আল্লাহ তোমাদের জন্য ফরয করে দিয়েছেন। এ মাসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং বন্ধ করে দেয়া হয় জাহান্নামের সব দরজা। এ মাসে বিদ্রোহী শয়তানগুলোকে কয়েদ করা হয়। … …” [১]
“আবূ হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ রামাযান মাসের প্রথম রাতেই শয়তান ও দুষ্ট জ্বীনদের শৃঙখলাবদ্ধ করে ফেলা হয়।…” [২]
আমরা দেখলাম সংক্ষিপ্ত বিবরণে সাধারণভাবে শুধু শয়তানের কথা আছে। কিন্তু বিস্তারিত বর্ণনায় জিন-শয়তানের ক্ষেত্রে مَرَدَةُ, مَرِيدٍ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো একই জাতীয় শব্দ। অভিধানে এই শব্দগুলো এবং এদের সমজাতীয় কিছু শব্দের অর্থ করা হয়েছেঃ বিদ্রোহী হওয়া, বিদ্রোহ করা, ব্যতিক্রমধর্মী হওয়া, অনন্য হওয়া,উদ্ধত ইত্যাদি। [৩]
উপরে হাদিসের বঙ্গানুবাদেও আমরা দেখেছি যে শয়তানের ক্ষেত্রে বিদ্রোহী, দুষ্টু ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ, হাদিসের বিস্তারিত বিবরণে দেখা যাচ্ছে রমযান মাসে এক বিশেষ শয়তানকে বন্দী করা হয় যারা এই বিশেষণে বিশেষায়িত।
মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যাঃ
ইবন খুযাইমাহ(র.) তাঁর সহীহ (৩/১৮৭-১৮৮) গ্রন্থে বলেছেন, “এখানে শয়তানকে বন্দী করাকে সাধারণ একটি কথার দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে তবে এর উদ্যেশ্য সুনির্দিষ্ট। “শয়তানকে বন্দী করা হয়” এই কথার দ্বারা তিনি বলতে চেয়েছেন তাদের মধ্যে ‘মারাদাহ’ (বিদ্রোহী/দুষ্টু) জিনদেরকে বন্দী করা হয়। সব শয়তানকে না। কেননা ‘শায়াতিন’ (শয়তান এর বহুবচন) দ্বারা কিছু জিনকে বোঝানো হয়।”
ইবনে হিব্বান(র.) তাঁর ‘আল ইহসান’ (৮/২২১) গ্রন্থে বলেছেন, “রমাযান মাসে শুধুমাত্র ‘মারাদাহ’ শয়তানদেরকে বন্দী করা হয়। অন্যদেরকে বাদ দিয়ে।” [৪]
এ প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী(র.) বলেছেন,
“[শয়তানকে] শুধুমাত্র সেসব সাওম পালনকারীর (রোযাদার) জন্য শৃঙ্খলবদ্ধ করা হয় যারা সাওমের শর্তগুলো হেফাজত করে।” [৫]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,
“বন্দীকৃত শয়তানেরাও ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু তা রমযান মাসের বাইরের মাসগুলোর তুলনায় দুর্বলভাবে ও স্বল্প আকারে। এবং তা হয় সাওমের (রোযা) পরিপূর্ণতা ও ঘাটতি অনুসারে। কেউ যদি পরিপূর্ণভাবে [উত্তমভাবে, সব শর্তের হেফাজত করে] সিয়াম পালন করে, তার থেকে শয়তানকে দূরে রাখা হবে। যাদের সিয়ামে ঘাটতি রয়েছে [উত্তমভাবে হয়নি, শর্তগুলোর হেফাজত হয়নি], তাদের ক্ষেত্রে ঐভাবে শয়তানকে দূরে রাখা হবে না।” [৬]
মানুষের পাপের কারণ শুধু শয়তান নয়ঃ
মানুষ শুধুমাত্র শয়তানের প্ররোচনাতেই খারাপ কাজ করে বিষয়টা এমন নয়। নিজ প্রবৃত্তি ও রিপুর তাড়নাতেও মানুষ খারাপ কাজ করে। পাপে লিপ্ত হয়।
“তবে তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে আপন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? …” [৭]
‘আর আমি আমার নাফসকে পবিত্র মনে করি না, নিশ্চয় নাফস মন্দ কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, আমার রব যাকে দয়া করেন সে ছাড়া। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’। [৮]
এ কারণেই নবী(ﷺ) বলেছেন, যিয়াদ ইবনু ইলাক্বাহ (রহ.) হতে তার চাচা থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী(ﷺ) বলতেনঃ “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকটে গর্হিত চরিত্র, গর্হিত কাজ ও কু-প্রবৃত্তি হতে আশ্রয় চাই”। [৯]
এ প্রসঙ্গে শায়খ আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল (হাফি.) বলেছেন,
“…মানুষ কেবল শয়তানের কুমন্ত্রণায় পাপ করে না বরং পাপাচার সংঘটিত হওয়ার পেছনে শয়তান ছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। যেমন: মানুষ রিপুর কামনা-বাসনা ও কু প্রবৃত্তির তাড়নায় পাপ করে। আবার মানুষরূপী শয়তানের খপ্পরে পড়ে এবং বদ অভ্যাসের বশবর্তী হয়েও পাপ করে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, যখন আল্লাহ তাআলা ইবলিসকে প্রথম মানব আদম আ. কে সেজদা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তখন সে আল্লাহর নির্দেশ লঙ্ঘণ করেছিলো। এখানে প্রশ্ন হল, কোন শয়তান তাকে আল্লাহর অবাধ্যতা করতে প্ররোচিত করেছিলো? না, কোনো শয়তান নয় বরং তার ভেতরের অহংবোধ ও কুপ্রবৃত্তির কারণে সে আল্লাহর অবাধ্যতা করেছিলো।
তাই তো হাদিসে রমাযান মাসে রোযাদারদেরকে কুপ্রবৃত্তি, বদ অভ্যাস ও খারাপ আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলা হয়েছে।” [১০]
অতএব উপরের কুরআন-হাদিসের দলিল প্রমাণ এবং উলামাদের আলোচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি—
রমযান মাসেও মানুষ খারাপ কাজ করে, কারণঃ
১। রমযান মাসে সব শয়তান বন্দী থাকে না, শুধু মারাদাহ বা মারিদ শয়তান বন্দী থাকে। অন্য শয়তানরা মুক্ত থাকে।
২। বন্দী শয়তানেরা স্বল্প আকারে ক্ষতি করতে পারে। যারা পূর্ণাঙ্গভাবে শর্ত পালন করে সিয়াম পালন করে, তাদের থেকে শয়তানকে দূরে রাখা হয়। অন্যান্যরা এর আওতাভুক্ত না।
৩। শুধু শয়তানের কুমন্ত্রণায় না বরং মানুষ সাধারণভাবে নাফস বা প্রবৃত্তির তাড়নাতেও এবং অভ্যাসবশতও খারাপ কাজ করে থাকে।
রমযান মাসে বিদ্রোহী শয়তানের বন্দী থাকা বা ক্ষতিকর প্রভাব কমে যাবার নিদর্শন আমরা দেখতে পাই এই মাসে মানুষের অধিক পরিমাণে সলাত আদায়, দান-সদকাহ এবং অন্যান্য সৎকাজ করা এবং অপেক্ষাকৃত কম পাপ কাজে লিপ্ত থাকার প্রবণতা থেকে।
রমযান মাসে শয়তান যেভাবে বদরের ময়দানে উপস্থিত ছিলোঃ
১। রমযান মাসে সকল শয়তান বন্দী থাকে না, শুধুমাত্র মারাদাহ/মারিদ শয়তান বন্দী থাকে। অন্য শয়তানদের পক্ষে রমযান মাসেও এভাবে আবির্ভূত হওয়া সম্ভব।
২। বদরের যুদ্ধের ঘটনায় দেখা যায় শয়তান মুশরিকদের মাঝে ছিলো। মুসলিমদের মাঝে না। ঈমানদার মুসলিম, যারা যথাযথভাবে সিয়াম পালন করে, তাদের থেকে শয়তানকে দূরে রাখা হয়। মুশরিকরা ঈমানদার না, তাদের সিয়াম পালনের ব্যাপার নেই। তাদের থেকে শয়তানকে দূরে রাখা হয় না।
অতএব রমযান মাসে শয়তানের বন্দী থাকার হাদিসের সাথে এই মাসে মানুষের খারাপ কাজ করা বা বদরের ময়দানে শয়তানের উপস্থিত থাকার ঘটনা মোটেও সাংঘর্ষিক বা পরস্পরবিরোধী কিছু না।
তথ্যসূত্রঃ
_______________________________________
[১] নাসায়ী ২১০৬, ইবনু আবী শায়বাহ্ ৮৮৬৭, আহমাদ ৭১৪৮, সহীহ আত্ তারগীব ৯৯৯, সহীহ আল জামি‘ ৫৫, শু‘আবূল ঈমান ৩৩২৮। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং : ১৯৬২ (সহীহ)
[২] সুনান তিরমিযি, হাদিস নং : ৬৭৯ (সহীহ)
[৩] আল মুনীর আরবী-বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা ৯৩৩
[৪] https://al-maktaba.org/book/22886/281#p8
[৫] https://al-maktaba.org/book/32159/23#p20
[৬] মাজমু’উল ফাতাওয়া ২৫/২৪৬
[৭] আল কুরআন, জাছিয়াহ ৪৫ : ২৩
[৮] আল কুরআন, ইউসুফ ১২ : ৫৩
[৯] জামে' আত-তিরমিজি, হাদিস নং : ৩৫৯১ (সহীহ)
[১০] "রমজান মাসে শয়তানদেরকে শেকল বন্দি করার পরও কিভাবে তারা মানুষের মনে কুমন্ত্রণা দেয়"
Writer: Muhammad Musfikur Rahman Minar
0 মন্তব্যসমূহ