স্বামী বিবেকানন্দের দৃষ্টিতে ইসলাম।
ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, "দেখা যাবে ইসলাম যেথায় গিয়েছে, সেথায়ই আদিম নিবাসীদের রক্ষা করেছে। সেসব জাত সেথায় বর্তমান। তাঁদের ভাষা, জাতীয়ত্ব আজও বর্তমান।" ( 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য', স্বামী বিবেকানন্দ, পৃঃ-118/)
ইসলাম এবং মুসলমানদের প্রশংসা করে স্বামীজি আরও বলেন। ... ইউরোপে যা কিছু উন্নতি হয়েছে, তার প্রত্যেকটিই ক্রীশ্চান ধর্মের বিপক্ষে বিদ্রোহ দ্বারা। আজ যদি ক্রীশ্চানীর শক্তি থাকতো তাহলে পাস্তের (Pasteur) এবং ককে'র (Koch) ন্যায় সকলকে জীবন্ত পোড়াত এবং ডারউইন কল্পদের শূলে দিত।... এর সঙ্গে ইসলামের তুলনা কর। মুসলমান দেশে যাবতীয় পদ্ধতি ইসলাম ধর্মের উপর সংস্থাপিত এবং ইসলামের ধর্মশিক্ষকেরা সমস্ত রাজকর্মচারীদের বহুপূজিত এবং অন্য ধর্মের শিক্ষকেরাও তাদের নিকট সন্মানিত।" (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য' পৃঃ- 118-119/ চেপে রাখা ইতিহাস, গোলাম আহমেদ মোর্তাজা )
বিবেকানন্দ বলেছেন, নিউ টেস্টামেন্টে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনোও বিজ্ঞান বা শিল্পের প্রশংসা নেই। কিন্তু এমন বিজ্ঞান বা শিল্প নেই যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কুরআন বা হাদীসের বহুবাক্যের দ্বারা অনুমোদিত এবং উৎসাহিত নয়।( দ্রঃ- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য:- স্বামী বিবেকানন্দ, পৃঃ-117/ বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ:- গোলাম আহমেদ মোর্তাজা, পৃঃ-124)
পৃথিবীর প্রথম ইউনিভার্সিটির স্রষ্টা মুসলমান জাতি- এটাকে দ্ব্যার্থহীন ভাবে স্বীকার করে বিবেকানন্দ লিখেছেন, "এদিকে মূর নামক মুসলমান জাতি স্পেন দেশে অতি সুসভ্য রাজ্য স্থাপন করলে, নানাবিদ্যার চর্চা করলে, ইউরোপে প্রথম ইউনিভার্সিটি হল; ইতালি, ফ্রান্স, সুদূর ইংল্যান্ড হতে বিদ্যার্থী বিদ্যা শিখতে এল; রাজা-রাজড়ার ছেলেরা যুদ্ধবিদ্যা আচার কায়দা সভ্যতা শিখতে এল। বাড়ি ঘর দোর মন্দির সব নতুন ঢঙে বনতে লাগলো।"( প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, পৃঃ-110/বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ, পৃঃ-127)
পবিত্র কুরআন সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেন, "কোরআনের একটি বিশেষত্ব, আজ পর্যন্ত এর উপরে কেউ কলম চালাতে পারেনি। 1100 বছর আগে তা যেমন ছিল, আজও ঠিক সেইভাবে আছে, একটিও নতুন কথা বসেনি। প্রাচীন পুস্তকের এমন বিশুদ্ধতা রক্ষা বড় দেখতে পাওয়া যায় না।"(বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ:- শঙ্করীপ্রসাদ বসু, পৃঃ 383)
ভারতে মুসলমানদের আগমন অমুসলমানদের জন্য যে আশীর্বাদ স্বরূপ ছিল তা বিবেকানন্দ অকপটে স্বীকার করে বলেছেন, "মুসলমানের ভারত বিজয় নিপীড়িত দরিদ্রের মুক্তির রুপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল। সেই কারনে আমাদের এক পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হয়ে গেছে। শুধু তরবারির দ্বারা সেটা সম্ভব হয়নি। এটা চরম বাতুলতা বলে পরিগণিত হবে যদি বলা হয় যে এসবই তরবারি ও ধ্বংসের পথে সাধিত হয়েছিল।"(স্বামী বিবেকানন্দ ও ইসলাম ধর্ম:- বিমলানন্দ শাসমল, পৃঃ-14)
হিন্দু এবং খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে ইসলাম ধর্মের তুলনা করে স্বামীজি ইসলামের সাম্য ভ্রাতৃত্বের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি লিখেছেন;- মুহাম্মদ(সাঃ) নিজ জীবনের দৃষ্টান্ত দ্বারা দেখাইয়া গেলেন যে, মুসলমানদের মধ্যে সম্পূর্ণ সাম্য ও ভ্রাতৃভাব থাকা উচিত। উহার মধ্যে বিভিন্ন জাতি মতামত বর্ণ লিঙ্গভেদ কিছু থাকিবে না। তুরস্কের সুলতান আফ্রিকার বাজার হইতে একজন নিগ্রোকে কিনিয়া তাহাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া তুরস্কে আনিতে পারেন। কিন্তু সে যদি মুসলমান হয় আর যদি তাহার উপযুক্ত গুন থাকে তবে সে সুলতানের কন্যাকেও বিবাহ করতে পারে। মুসলমানদের এই উদারভাবের সহিত এদেশে (আমেরিকায়) নিগ্রো ও রেড ইন্ডিয়ানদের প্রতি কিরূপ ব্যাবহার করা হয় তুলনা করিয়া দেখ। আর হিন্দুরা কি করিয়া থাকে- যদি তোমাদের একজন মিশনারি হঠাৎ কোনো এক গোঁড়া হিন্দুর খাদ্য ছুঁইয়া ফেলে, সে তৎক্ষণাৎ উহা ফেলিয়া দিবে।"( দ্রঃ- স্বামী বিবেকানন্দ ও ইসলাম ধর্ম: বিমলানন্দ শাসমল- পৃঃ 3)
খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের চরিত্রের তুলনা করে স্বামীজি জোর দিয়ে বলেছিলেন, "আসলে সভ্য ছিল মুসলমানেরাই- বর্বর ছিল খ্রিষ্টানরা তখন, যারা যুদ্ধকালে খাবার না পেলে মুসলমানদের লাশ খেয়ে ফেলত।" ইংরেজরা তাদের পাশবিক রিপু চরিতার্থ করতে নিহত মুসলমানদের মাংস খেত। সে কথাও বিবেকানন্দ বলেছেন, "এমনকি জানা গেল, আমাদের বড় ভক্তির সিংহ হৃদয় মহাত্মা রাজা রিচার্ড মুসলমান মাংসে বিশেষ খুশি ছিলেন, প্রসিদ্ধ আছে।"( সহাস্য বিবেকানন্দ: শঙ্করীপ্রসাদ বসু:-পৃঃ-172/ বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ: পৃঃ-128)।
স্বামীজী বলেছিলেন, "আমাদের মাতৃভূমির পক্ষে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মরুপ এই দুই মহান মতের সমন্বয়ই একমাত্র আশা। ...আমি দিব্যচোখে দেখিতেছি যে, বৈদান্তিক মস্তিস্ক এবং ইসলামী দেহ লইয়া ভবিষ্যতে ভারত গৌরবমন্ডিত হইয়া উঠিবে। অর্থাৎ ইসলামীয় দেহ এবং বৈদান্তিক মস্তিষ্ক এই দ্বিবিধ আদর্শে অনুপ্রাণিত হইয়া ঐ আদর্শের বিকাশসাধন করিয়া ভারতবাসী কল্যাণের পথে অগ্রসর হইবে।(দ্রঃ- লন্ডনে বিবেকানন্দ: মহেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃঃ 147-48, 1338, কলকাতা)।
স্বামী বিবেকানন্দ যে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন
তিনি যে মুসলমানদের ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন সে সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পেশ করা হলো। বর্তমানে সাম্প্রদায়িক কিছু দল বিবেকানন্দকে আদর্শ করে ইসলাম এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ও মারাত্মক ধরনের অপপ্রচার এবং সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। উপরে উদ্ধৃত বিবেকানন্দের নিজস্ব বক্তব্যগুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তাঁর নীতির সঙ্গে তাঁকে 'সামনে' করে বর্তমান সংগঠনগুলোর নীতির যে কতো পার্থক্য তা অনুমান করতে কষ্ট হবে না।
বিবেকানন্দর এই সমস্ত উক্তির দিকে নজর রেখে বলা যায়, বর্তমানে আধুনিক কোনো নকল স্বামীজী অথবা কোনো বিবেকানন্দ ভক্ত তাঁর মতোই নামের সঙ্গে নন্দ অথবা রাম-নাথ-দেব জুড়ে অথবা তাঁর মতোই গেরুয়া বস্ত আর মাথায় পাগড়ি বেঁধে যদি মুসলমানদের ভারত থেকে বিতাড়ন অথবা তাঁদেরকে হত্যা অথবা ধর্মান্তরিত বা শুদ্ধিকরণের কথা বলেন তা হলে তিনি যে 'পরিষদ' অথবা 'সংঘ'-'সংহতির' নেতা বা কর্তা হোন না কেন, তাকে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে, তাঁর আদর্শ ও নীতির সঙ্গে মেলালে মিলবে কিনা তার উত্তর সহজ ও সাধারন।
তা হলে কি স্বামীজীর কোনো গোপন ইতিহাস আছে, যাতে উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলোর বিপরীত কথা লেখা আছে?
বর্তমানের নকল ভন্ড 'স্বামীজী' যোগীজীরা কি সেই গোপন আদেশ ও আদর্শকেই মেনে চলেছেন? আজও যদি বিবেকানন্দের সেইসব স্বঘোষিত ভক্তরা সাবধান না হোন তাহলে স্বামী বিবেকানন্দের মহান ভাবমূর্তি কুয়াশাছন্নই থেকে যাবে, আর মানুষের মনে প্রশ্ন জাগবে- এই সাম্প্রদায়িক, মুসলিম ও সংখ্যালঘু- বিদ্বেষী উগ্রবাদীরা যে বিবেকানন্দের অনুসারী ও অনুগামী বলে দাবী করছেন তিনি কোন বিবেকানন্দ? তিনি সেই মহান অসাম্প্রদায়িক বিবেকানন্দ, নাকি সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট অন্য কোনও বিবেকানন্দ?
0 মন্তব্যসমূহ